বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বর্ণের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো—ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের তুলনায়ও বাংলাদেশে এখন স্বর্ণের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। অনেকেই প্রশ্ন করেন, একই অঞ্চলের দেশ হয়েও কেন এই পার্থক্য? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের দেখতে হয় বাংলাদেশের আমদানি কাঠামো, ডলার সংকট, সরকারি নীতি, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রভাব।
আমদানি নির্ভরতা ও ডলার সংকট: বাংলাদেশে কোনো স্বর্ণখনি বা স্থানীয় উৎস নেই, ফলে পুরোপুরি আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। স্বর্ণ আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার) ব্যবহার করতে হয়, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ডলার সংকট তীব্র হয়েছে। ডলারের বিনিময় হার ক্রমেই বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকারকদের খরচও বেড়েছে। এই অতিরিক্ত খরচ তারা বাজারমূল্যে যোগ করে দেয়, যার ফলে খুচরা পর্যায়ে স্বর্ণের দাম অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্রুত বেড়ে যায়। ভারত বা পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক খাতের মধ্যে ডলারের প্রবাহ তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল, তাই সেখানে আমদানি ব্যয় কম থাকে।

উচ্চ আমদানি শুল্ক ও করনীতি: বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানির ক্ষেত্রে সরকার তুলনামূলকভাবে উচ্চ হারে শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ করে। সরকার রাজস্ব বাড়ানোর জন্য এই নীতি অনুসরণ করে, কিন্তু এর ফলে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ পড়ে। অন্যদিকে, ভারত বা নেপালে সরকার কিছুটা শিথিল নীতি গ্রহণ করেছে—বিশেষ করে ভারতের “গোল্ড বন্ড স্কিম” ও “গোল্ড রিসাইক্লিং পলিসি” স্থানীয় সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের তুলনায় সেসব দেশে স্বর্ণের দাম কম রাখা সম্ভব হচ্ছে।
চোরাচালান ও অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের প্রভাব: বাংলাদেশে স্বর্ণের একটি বড় অংশ এখনো অনানুষ্ঠানিক বা অবৈধ পথে আসে। সীমান্ত দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানি করা হয়, যা ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল। এই ঝুঁকির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত দাম ধার্য করেন। উপরন্তু, এই চোরাচালানমূলক বাণিজ্য সরকারকে রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত করে, ফলে বৈধ আমদানিকারকদের ওপর করের চাপ আরও বেড়ে যায়। এভাবে বৈধ বাজারের দাম ধীরে ধীরে বেড়ে যায়।
সরবরাহ ঘাটতি ও চাহিদার চাপ: বাংলাদেশে স্বর্ণ কেবল অলংকার হিসেবেই নয়, বিনিয়োগের বিকল্প মাধ্যম হিসেবেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বা মুদ্রাস্ফীতির সময় অনেকেই নিরাপদ সম্পদ হিসেবে স্বর্ণে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু দেশে বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি সীমিত হওয়ায় সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হয়। চাহিদা বেশি, সরবরাহ কম—এই ভারসাম্যহীনতা বাজারমূল্য বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, ভারতে বা নেপালে স্বর্ণ আমদানির ব্যবস্থা অনেক বেশি উন্মুক্ত, ফলে তাদের বাজারে সরবরাহ স্থিতিশীল থাকে।

আপনি যদি একজন শিক্ষার্থী হয়ে থাকেন, তাহলে পড়াশুনার পাশাপাশি নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে ফ্রিল্যান্সিং করুন।
Fb: https://www.facebook.com/cloudemy20
Web: thecloudemy.com
নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় সীমাবদ্ধতা: বাংলাদেশ ব্যাংক বা সরকার এখনো পর্যন্ত স্বর্ণ বাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় খুব সক্রিয় ভূমিকা নেয়নি। ভারতের মতো নিয়মিত “গোল্ড আমদানি স্কিম”, সরকারি ক্রয়বিক্রয় ব্যবস্থা বা গোল্ড বন্ড বাজার বাংলাদেশে নেই। ফলে পুরো বাজারটি বেসরকারি খাতের হাতে, যা মূল্য নিয়ন্ত্রণে দুর্বল। এছাড়া, মান নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা ও আমদানির তথ্যের অভাব বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে।
আন্তর্জাতিক বাজার ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব: বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম সাধারণত মার্কিন ডলারের মান, সুদের হার, এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ওপর নির্ভর করে। যখন ডলারের মান বাড়ে বা আন্তর্জাতিক সংকট দেখা দেয়, তখন বিশ্বব্যাপী স্বর্ণের দাম বেড়ে যায়। বাংলাদেশ এই প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। তবে, দেশের নিজস্ব মুদ্রা টাকার মান দুর্বল হলে সেই প্রভাব আরও প্রকট হয়—যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটেছে।
সবকিছু মিলিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে একাধিক যৌথ কারণ—
ডলার সংকট, উচ্চ আমদানি শুল্ক, চোরাচালানের প্রভাব, সরবরাহ ঘাটতি, বাজার নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা এবং আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা। এই সব কারণ একসঙ্গে কাজ করে বাংলাদেশের বাজারে স্বর্ণের দামকে ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের তুলনায় উঁচু পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশে স্বর্ণের উচ্চমূল্য শুধু সাধারণ ক্রেতার জন্য নয়, গোটা অর্থনীতির জন্যও একটি চ্যালেঞ্জ। সরকার যদি স্বর্ণ আমদানির নিয়ম সহজ করে, শুল্ক কিছুটা হ্রাস করে এবং বৈধ বাজার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে, তাহলে দাম কিছুটা স্থিতিশীল হতে পারে। একই সঙ্গে স্বর্ণ রিসাইক্লিং ও ডিজিটাল স্বর্ণ বিনিয়োগ ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করা হলে ভবিষ্যতে দেশের বাজারে স্থিতি ফিরে আসতে পারে।

