পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের একটি ভিজে রাস্তায় শুরু হয়েছিল এই বেদনাদায়ক গল্পের যাত্রা। বয়স তখন মাত্র ১০—এক বর্ষণমুখর দুপুরে আইসক্রিম কিনতে বেরিয়েছিল ছোট্ট কিরণ। আইসক্রিমের খোঁজ সে পেয়েছিল, কিন্তু হারিয়ে ফেলেছিল নিজের শৈশব, পরিবার আর পরিচিত পৃথিবী।
কাসুর জেলার একটি ছোট গ্রামে বাবা-মা ও ভাইবোনদের সঙ্গে থাকত কিরণ। কিন্তু নিখোঁজ হওয়ার পর তার দিন কেটেছে করাচির ইধি ফাউন্ডেশনের একটি হোমে—পরিবার থেকে বহু দূরে, অচেনা মানুষের আশ্রয়ে। বাবা-মা মরিয়া হয়ে খুঁজেছেন, তবু কোথাও তার সন্ধান মেলেনি। ১৭ বছরের সেই হতাশা অবশেষে রূপ নেয় আশায়, যখন ‘সেফ সিটি প্রজেক্ট’-এর কর্মকর্তারা কিরণ সম্পর্কে একটি সম্ভাব্য সূত্র পান।

কীভাবে হারিয়ে গেল কিরণ
কিরণের জেঠু আসাদ মুনির জানান, ২০০৮ সালে ইসলামাবাদের জি-১০ এলাকায় তার পিসির বাড়িতে ছিল সে। বৃষ্টির দিনে ঠিক সামনের জি-১০ সেন্টারে আইসক্রিম কিনতে গিয়েছিল। কিন্তু বাড়ি আর খুঁজে পায়নি। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে পথ ভুলে ঘুরতে থাকে। পরে এক ব্যক্তি তাকে নিয়ে যান ইসলামাবাদের ইধি সেন্টারে।
কিরণ জানান, প্রথমে তাকে রাখা হয় ইসলামাবাদের শাখায়। কিছুদিন পর বিলকিস ইধি তার শারীরিক অবস্থা খারাপ দেখে তাকে করাচির ইধি সেন্টারে নিয়ে যান। সেখানেই কাটে দীর্ঘ ১৭টি বছর—পড়াশোনা, রান্না, সেলাই শেখা এবং নতুন পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা।
‘মেরা প্যায়ারা’ প্রকল্প বদলে দিল সবকিছু
পাঞ্জাব পুলিশের ‘সেফ সিটি’ কর্মসূচির আওতাধীন ‘মেরা প্যায়ারা’ প্রকল্পের লক্ষ্য—হারিয়ে যাওয়া শিশুদের পরিবারে ফিরিয়ে দেওয়া। লাহোরে এই প্রকল্পের সিনিয়র কর্মকর্তা সিদরা ইকরাম জানান, এক বছরে তারা ৫১ হাজার শিশুকে পরিবারে ফেরাতে সক্ষম হয়েছেন।
এক দল করাচির ইধি সেন্টারে গিয়ে কিরণের সাক্ষাৎকার নেয়। খুব বেশি কিছু মনে না থাকলেও সে জানায়—তার গ্রামের নাম কাসুর, বাবার নাম আব্দুল মাজিদ, আর ইসলামাবাদে আত্মীয়দের সঙ্গে থাকত।
এই তথ্য পাঠানো হয় কাসুরে। পুলিশ কর্মকর্তা মুবশ্বির ফইয়াজ জানান, এলাকায় একই নামে বহু মানুষ থাকায় খোঁজ পাওয়া কঠিন ছিল। ছোটবেলার ছবি দেখিয়েও লাভ হয়নি। তবে একজন পুরোনো পুলিশ সদস্য মনে করেন—এই এলাকায় বছরখানেক আগে ‘কিরণ’ নামে এক শিশুর নিখোঁজ সংক্রান্ত অভিযোগ নেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকেই শুরু হয় আসল অগ্রগতি।
মসজিদে ঘোষণা, স্থানীয় প্রবীণদের সঙ্গে আলাপ আর দরজায় দরজায় খোঁজ—অবশেষে নিশ্চিত হওয়া যায়, আব্দুল মাজিদের মেয়ে কিরণই সেই হারানো শিশু।

১৭ বছর পর বাবা-মেয়ের পুনর্মিলন
মুবশ্বির ফইয়াজ জানান, আব্দুল মাজিদকে কিরণের বর্তমান ও শিশুকালের ছবি দেখানো হলে তিনি নিশ্চিত হন—এটাই তার মেয়ে। ফর্ম-বি (শিশু নিবন্ধন সনদ) দেখিয়ে তিনি প্রমাণও দেন। এরপর ভিডিও কলে বাবা-মেয়ের কথা হয়—সেই মুহূর্ত আবেগে ভরা। করাচিতে গিয়ে সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে কিরণকে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
২৫ নভেম্বর, দীর্ঘ ১৭ বছর পর কিরণ ফিরে আসে নিজের ঘরে।
কিরণের মামা আসাদ মুনির বলেন, বড় মেয়েকে হারানোর দুঃখে আগেই বুড়িয়ে গিয়েছিলেন আব্দুল মাজিদ। “যখন তিনি তাকে চিনলেন, তার চোখের জল থামছিল না—কিন্তু এবার সেই জল আনন্দের।”
কিরণের নিজের অনুভূতি
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে কিরণ জানান, পরিবারে ফিরে তিনি খুবই উচ্ছ্বসিত। ইধি সেন্টারের প্রতি কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেন—সেখানে আমি সাহস পেয়েছি, পড়াশোনা শিখেছি, রান্না ও সেলাই শিখেছি। কঠিন সময়ে তারা আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।

