রমজানকে ঘিরে দেশজুড়ে ভোগ্যপণ্যের বাজারে যেন এক ধরনের আগাম প্রস্তুতির আমেজ তৈরি হয়েছে। কারণ প্রতিবছর এ মাসে খাদ্যপণ্যের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ব্যবসায়ীরা তাই ঝুঁকি না নিয়ে আগেভাগেই ছোলা, খেজুর, মটর ডাল, চিনি, ভোজ্যতেল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য এলসি খোলা বাড়িয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর–অক্টোবরে আগের বছরের তুলনায় কিছু পণ্যের এলসি খোলার হার বেড়েছে ১১ থেকে ২৯৪ শতাংশ পর্যন্ত—যা বাজারে রমজান আগমন বার্তা আগে থেকেই স্পষ্ট করে দিয়েছে। এ অবস্থায় দেশের ব্যাংকিং খাতেও স্বস্তি, কারণ বর্তমানে ডলারের কোনো সংকট নেই বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। ঘোষিত দামেই আমদানিকারকেরা সহজে ডলার পাচ্ছেন, ফলে আমদানির গতি আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।

প্রধান খাদ্যপণ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে মটর ডালে—বিস্ময়করভাবে ২৯৪ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে ৪১ হাজার ৮১৫ মেট্রিক টন থেকে তা লাফিয়ে উঠে হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮১০ মেট্রিক টন। খেজুরেও রেকর্ড ২৩১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে, যা রমজানের বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভোজ্যতেল, ছোলা, অন্যান্য ডাল ও চিনির আমদানিও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, যা নির্দেশ করে—দেশের খাদ্যবাজারে ঘাটতির আশঙ্কা নেই বরং সরবরাহ হবে আরও স্বচ্ছন্দ।
তবে বিপরীত চিত্র দেখা গেছে পেঁয়াজ, রসুন ও আদার ক্ষেত্রে। নতুন মৌসুম আসন্ন হওয়ায় এবং পেঁয়াজ আমদানিতে সরকারি অনুমোদন না থাকায় এ পণ্যের এলসি কমে গেছে প্রায় ৯৯ শতাংশ। রসুনের আমদানিও ৮৯ শতাংশ কমেছে; আদার ক্ষেত্রে হ্রাস ২২ শতাংশ। অর্থাৎ এ তিনটি পণ্যে বাজার অনেকটাই স্থানীয় সরবরাহ ও মৌসুমি উৎপাদনের ওপর নির্ভর করবে।
এলসি বৃদ্ধির এই প্রবণতা সামগ্রিক আমদানি খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে যেখানে সামগ্রিক এলসি খোলা ছিল মাত্র ০.১৮ শতাংশ, সেখানে চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই প্রবৃদ্ধি পৌঁছেছে ১০.৮২ শতাংশে। শুধু খাদ্যপণ্য নয়—মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালসহ উৎপাদন–সম্পর্কিত আমদানিও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা অর্থনীতিতে একটি পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দেয়।
তবে একটি উদ্বেগ রয়ে গেছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে। ব্যাংক খাতে সামগ্রিক আমদানি বাড়লেও বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি ক্রমেই কমছে—সেপ্টেম্বরে নেমে এসেছে ৬.২৯ শতাংশে, যা গত বছরের আগস্টে ছিল ৯.৮৬ শতাংশ। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর কিছু ব্যবসায়ীর অনিশ্চয়তা, ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার প্রবণতা এবং পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন হওয়া ১৫টি ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম সীমিত করে দেওয়ায় ঋণ প্রবৃদ্ধিতে এই মন্থরতা দেখা গেছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, রমজানকে ঘিরে খাদ্যপণ্যে এলসি খুলে আমদানির যে গতি বেড়েছে, তা বাজারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ ও উৎপাদন কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলতে পারে—এমন আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

