জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে, তার কেন্দ্রে একজনই ব্যক্তি—ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে সারাদেশে যে অভূতপূর্ব হারে মামলা দায়ের হতে শুরু করে, তা এখন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, থানায় ও আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৮৬-এ। এসব মামলার প্রকৃতি যতটা বৈচিত্র্যময়, ততটাই গুরুতর। অধিকাংশ মামলায় তাঁকে অপহরণ, হত্যাচেষ্টার নির্দেশদাতা, রাজনৈতিক সহিংসতার পরিকল্পনাকারী এবং বিভিন্ন ঘটনার হুকুমদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগের পরিমাণই বেশি—মোট ৩২৪টি হত্যা মামলা, যা মোট মামলার প্রায় ৫৫ শতাংশ। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর বিরুদ্ধে পৃথকভাবে ছয়টি দুর্নীতির মামলাও করেছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় জমা পড়েছে আরও প্রায় অর্ধশত অভিযোগ, যার মধ্যে পিরোজপুরের সুখরঞ্জন বালি, মাইকেল চাকমা, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদসহ আরও অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তির করা অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে যাচাই-বাছাই চলমান রয়েছে এবং তদন্তে সত্যতা নিশ্চিত হলে সেগুলোকে আনুষ্ঠানিক মামলায় রূপান্তর করা হবে।

এত বড় পরিসরে মামলা দায়েরের ধারার সূচনা হয় গত বছরের ১৩ আগস্ট, যখন মোহাম্মদপুর থানায় আবু সাঈদ হত্যার অভিযোগে প্রথম মামলা রুজু করা হয়। এরপরই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় একের পর এক মামলা হতে থাকে; আন্দোলন-পরবর্তী অস্থিরতা ও সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নতুন অভিযোগ জমা পড়তে থাকে প্রতিদিন। পুলিশের সদরদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান জানায়, গত বছরের জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর সারাদেশে মোট ১,৬১২টি মামলা রেকর্ড হয়েছে। এ মামলাগুলোর মধ্যে হত্যা মামলা ৫৯৯টি, আর সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, দখলবাজি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অভিযোগে দায়ের হয়েছে ১,০০৩টি মামলা। এই সামগ্রিক মামলার মাঝেই শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে ৫৮০টিরও বেশি মামলায়—যা সংখ্যার বিচারে দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক মামলাগুলোর একটি। তদুপরি, আদালত অবমাননার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ডও প্রদান করেছে ২ জুলাইয়ের রায়ে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে—এত বিপুল সংখ্যক মামলা যে বিচারিক কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে, তা কতটা স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত? এ বিষয়ে বিভিন্নমুখী বক্তব্য পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম দাবি করেছেন যে, ট্রাইব্যুনালে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, স্বাভাবিক ও আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার চলছে। তাঁর মতে, দেশে যে বিশৃঙ্খলা বা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে, তা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে, এবং এই বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে থেকেও সঠিক পথেই এগোচ্ছে। প্রসিকিউশনের বক্তব্যের ভিত্তিতে বলা যায়, তাঁরা বিচার প্রক্রিয়ার ন্যায়সংগত প্রয়োগ নিয়ে আশাবাদী এবং বিশ্বাস করেন যে, মামলাগুলো আইনের নির্ধারিত কাঠামোর মধ্যেই নিষ্পত্তি হবে।

Tax VAT Business Consultants ব্যক্তি ও কোম্পানি করদাতাদের আয়কর, ভ্যাট এবং ব্যবসায়িক বিষয়ক পরামর্শ, আয়কর রিটার্ন দাখিল ও প্রশিক্ষণ সেবা প্রদান করে। taxvatbusiness.tch24.com
কিন্তু আইনি মহলের একটি অংশ পুরো বিষয়টি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছেন। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব মামলার রায় বা বিচার প্রক্রিয়া টেকসই হবে না। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিচারিক সিদ্ধান্ত পাল্টে যাওয়ার নজির বহুবার দেখা গেছে। তিনি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন—ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা বাতিল হয়। তাঁর মতে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে একই রকম পরিস্থিতি শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। এ কারণে তিনি এই বিচারকে রাজনৈতিক বলে মনে করেন এবং বলেন যে, শাস্তি হলো বা হলো না—এটি তাঁর কাছে বিচার প্রক্রিয়ার বৈধতা নির্ধারণের প্রকৃত সূচক নয়; বরং পুরো বিচার প্রক্রিয়াটি তাঁর দৃষ্টিতে রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাবাধীন।
এইভাবে বিভিন্ন তথ্য, পরিসংখ্যান, আইনি মতামত এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণকে একত্রে বিবেচনায় নিলে স্পষ্ট হয় যে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো শুধু একটি রাজনৈতিক অধ্যায়ের নয়, বরং একটি গভীর সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। একদিকে আইনের শাসন নিশ্চিত করার দাবি, অন্যদিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার অভিযোগ—এই দুইয়ের মাঝেই প্রশ্ন ওঠে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা, প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সামগ্রিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মামলা কোনো নতুন বিষয় নয়, কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ মামলা এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে একই সময়ে দায়ের হওয়া অভূতপূর্ব, এবং এর পরিণতি দেশীয় রাজনীতির গতিপথে দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব ফেলবে বলেই মনে হয়। এই মামলাগুলোর নিষ্পত্তি—যেভাবেই হোক—বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, গণতান্ত্রিক কাঠামো ও বিচারব্যবস্থার প্রতি জনবিশ্বাসকে প্রভাবিত করবে বহু বছর ধরে।

