ইরানের রাজধানী তেহরান বর্তমানে এক ভয়াবহ পানি সংকটের মুখোমুখি। শহরটির পানির রিজার্ভ এমন পর্যায়ে নেমে এসেছে যে, বিশেষজ্ঞদের মতে এটি সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ পর্যন্ত এক কোটি মানুষের প্রয়োজন মেটাতে পারবে। তেহরান মহানগর অঞ্চল, যেখানে প্রায় দেড় কোটি মানুষ বাস করে, সেই বিশাল জনসংখ্যার জন্য এই পানি সংকট এখন জীবন-মরণের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তেহরানের পানির মূল উৎস হলো পাঁচটি বড় জলাধার — আমির কাবির (Amir Kabir), লাতিয়ান (Latyan), মামলু (Mamloo), লার (Lar), এবং তেলার (Taleghan) বাঁধ। এসব জলাধারে পানির স্তর এখন ভয়ঙ্করভাবে কমে গেছে; কিছু ক্ষেত্রে মজুতের মাত্র ৮ থেকে ১০ শতাংশ পানি অবশিষ্ট রয়েছে। জলাধারে নতুন করে বৃষ্টির পানি জমছে না, বরং দীর্ঘমেয়াদি খরার কারণে নদী ও ভূগর্ভস্থ জলস্তর দ্রুত নিচে নামছে। ফলে রাজধানীর পানির সরবরাহ ব্যবস্থা হুমকির মুখে।
ইরানের পানি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বর্তমানে তেহরানে এমন পরিমাণ পানি মজুত আছে যা শহরের বাসিন্দাদের সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে পারবে। তাই রাতের বেলায় পানি সরবরাহ সীমিত করা, রিজার্ভ বাড়াতে নির্দিষ্ট সময়ে পানির চাপ কমানোসহ নানা জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অনেক এলাকায় নাগরিকরা ইতিমধ্যেই পানি কম পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। বিশেষ করে উচ্চতল ভবন বা শহরের প্রান্তিক এলাকাগুলোতে পানি পৌঁছানো আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রথমত, তেহরান ও এর আশপাশের অঞ্চলে কয়েক বছর ধরেই বৃষ্টিপাতের ঘাটতি চলছে। ২০২4 এবং ২০২5 সালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ গড়ে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে যাওয়ায় নিচের স্তর শুকিয়ে যাচ্ছে। কৃষি ও শিল্পে প্রচুর পরিমাণে পানি ব্যবহৃত হচ্ছে, অথচ এর যথাযথ পুনঃচক্রায়ন বা সংরক্ষণ হচ্ছে না। তৃতীয়ত, পুরনো পানি সরবরাহ অবকাঠামো নষ্ট হয়ে গেছে, যার ফলে প্রচুর পানি লিক হয়ে অপচয় হচ্ছে।

ফ্রিল্যান্সিং হতে পারে আপনার স্বাধীন আয়ের নতুন পথ। web: http://thecloudemy.com Fb: https://www.facebook.com/cloudemy20
তেহরানের পানি সংকট এখন কেবল পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক ও মানবিক সংকটেও পরিণত হচ্ছে। পানির অভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকি, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ভোগান্তি, এমনকি অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। অনেক পরিবার এখন বাড়িতে পানি মজুত রাখার চেষ্টা করছে, কেউ কেউ পানি কিনে ব্যবহার করছে। হাসপাতাল, স্কুল, রেস্তোরাঁ এমনকি শিল্পকারখানাগুলোর কার্যক্রমও হুমকির মুখে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, যদি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তবে রাজধানীজুড়ে পানি রেশনিং ও সীমিত সরবরাহ স্থায়ী আকার ধারণ করতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সংকট শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণে নয়; এর পেছনে রয়েছে পরিকল্পনার ঘাটতি ও অব্যবস্থাপনা। বহু বছর ধরে ইরানে পানি ব্যবস্থাপনায় যথাযথ বিনিয়োগ হয়নি। নগরায়নের দ্রুত প্রসার, অকার্যকর পানি ব্যবহার, এবং আধুনিক প্রযুক্তির অভাব—সব মিলিয়ে আজকের এই বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। সমাধান হিসেবে তারা বলছেন, সরকারের উচিত দ্রুত পানি সংরক্ষণ কর্মসূচি, বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ব্যবস্থা, এবং জলাধার পুনরুদ্ধার প্রকল্প চালু করা। পাশাপাশি, নাগরিকদেরও পানি ব্যবহারে সচেতন হতে হবে।
তেহরানের এই সংকট কেবল একটি শহরের গল্প নয় — এটি গোটা অঞ্চলের জন্য একটি সতর্কবার্তা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ও দীর্ঘ খরার কারণে পানির ঘাটতিতে ভুগছে। ইরানের রাজধানী এখন যে বিপদের মুখে, তা ভবিষ্যতে আরও শহরের জন্য ভয়ঙ্কর বাস্তবতা হয়ে উঠতে পারে। তাই এখনই সময়, সরকার ও জনগণের সম্মিলিতভাবে পানি ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ সংরক্ষণের দিকে গুরুত্ব দেওয়া। অন্যথায়, “তেহরানে দুই সপ্তাহের পানি” হয়ে উঠবে এক গভীর মানবিক ট্র্যাজেডির সূচনা।

