জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও আয় বাড়ছে না, হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ

Date:

Share post:

জীবনযাত্রার ব্যয় প্রতিনিয়ত বাড়ছে, কিন্তু অনেকের আয় স্থবির। ফলে আয়-ব্যয়ের হিসেব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন মোহাম্মদ বাবুলের মতো অসংখ্য মানুষ। ঢাকায় রিকশা চালিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারের খরচ চালান তিনি। প্রতিদিন জমা ও খরচ বাদ দিয়ে হাতে থাকে ৭০০-৮০০ টাকা। এর মধ্যে থাকা-খাওয়া ও ব্যক্তিগত খরচ বাদ দিয়ে তিনি গ্রামে পাঠান ১২-১৩ হাজার টাকা, যা দিয়ে চলে দুই সন্তানের পড়াশোনা ও মায়ের চিকিৎসা।

রাজধানীর গুদারাঘাট এলাকায় কথা হয় বাবুলের সঙ্গে। ব্যাটারি রিকশার ভিড়ে আয় কমে গেছে বলে জানান তিনি। তাঁর কণ্ঠে হতাশা—”পোলাটা সেভেনে পড়ে। মনে হয় বেশিদিন আর স্কুলে যাইতে পারবো না।”

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)-এর সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা বলছে, দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭.৯৩ শতাংশে, যেখানে ২০২২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর হিসাবে এই হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ। অর্থাৎ, তিন বছরে দারিদ্র্য বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ

বিশ্বব্যাংকও একই ধরনের বার্তা দিয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে আরও ৩০ লাখ মানুষ অতি দরিদ্র শ্রেণিতে পড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে তারা।

পিপিআরসির গবেষণা অনুযায়ী, শহরাঞ্চলে মানুষের আয় কমেছে, কিন্তু খরচ বেড়েছে। গরিব পরিবারগুলো খরচ মেটাতে বাধ্য হয়ে ঋণের বোঝা নিচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, একটি পরিবারের মোট খরচের ৫৫ শতাংশই ব্যয় হয় খাবারে, এর পাশাপাশি শিক্ষা ও চিকিৎসার খরচও দ্রুত বাড়ছে।

গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকা প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ যে কোনো বড় দুর্যোগে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। সামাজিক সুরক্ষা খাতেও রয়েছে অনিয়ম ও ঘুষ। সরকারি সহায়তার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে সহায়তা পৌঁছাচ্ছে না বলেও অভিযোগ অংশগ্রহণকারীদের।

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। রামপুরা ও ভাটারা বাজারে সবজির দামে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে তর্ক লেগে যায়। এক ক্রেতার মন্তব্য, “ছোট্ট একটা শাকের আটি ৪০ টাকা হয় কেমনে?” বিক্রেতার উত্তর, “কেনা বেশি দামে, তাই বিক্রিও বেশি।”

ভাটারা থানার সামনে ভ্যানগাড়িতে ফল বিক্রি করে সংসার চালান মিলন মাহমুদ। তিনি বলেন, “মানুষ কম কেনে, আমার ইনকামও কমে যায়।” আরেকদিকে, টিসিবির ট্রাকে কিছুটা কম দামে পণ্য কিনতে শত শত মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। তিন বছরের সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সালেহা বেগম বলেন, “মাছ-মাংস তো খাওয়াই বন্ধ কইরা দিছি, চাল-ডালও মেপে খাই।”

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনার পরবর্তী সময়ে সরকারের ব্যর্থতা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা সংকট এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতিকে দারিদ্র্য ও বৈষম্যের দিক থেকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বের অনেক দেশে পণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে তা হয়নি, বরং বেড়েছে। ফলে প্রকৃত আয় কমে গেছে।”

ড. সেলিম রায়হান বলছেন, “দারিদ্র্য বিমোচনে যতটা অগ্রগতি হয়েছিল, তা এখন হারিয়ে গেছে। নতুন করে বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।”

তিনি আরও বলেন, “মূল্যস্ফীতি এখনো ৮-৯ শতাংশে রয়ে গেছে, যদিও একসময় তা ছিল ১২-১৪ শতাংশ। তবে এতেও সাধারণ মানুষের কষ্ট কমছে না।”

অর্থনীতিবিদরা জোর দিচ্ছেন সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ ও দক্ষতা বাড়ানোর ওপরড. জাহিদ হোসেন বলেন, “সরকার যেটুকু ব্যয় করছে, তার বড় অংশই লক্ষ্য জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাচ্ছে না। সহায়তা কর্মসূচির পরিধি, ভাতা ও দক্ষতা—এই তিনটিই বাড়াতে হবে।”

তবে দারিদ্র্যের হার বাড়লেও এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশের) গ্রাজুয়েশন প্রক্রিয়ায় বড় কোনো প্রতিবন্ধকতা হবে না বলে মনে করেন ড. সেলিম রায়হান। তবে তিনি সতর্ক করেন, “এই উত্তরণের জন্য আমাদের প্রস্তুতি কেমন, সেটি এখন পর্যালোচনার সময়। রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ানো এখন জরুরি।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

Related articles

সালমান মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন,সামিরার কোনো দোষ দেখি নাই—ডনের মন্তব্যে

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়ক সালমান শাহের রহস্যজনক মৃত্যু আবারও নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। আত্মহত্যা নাকি হত্যা—এই বিতর্কে...

টাইফয়েডমুক্ত প্রজন্মের পথে বাংলাদেশ: বিনামূল্যে টিকা দিচ্ছে সরকার

বাংলাদেশে টাইফয়েড একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। টাইফয়েড...

শরীর হঠাৎ অবশ হয়ে যাচ্ছে? সতর্ক থাকুন, এটি হতে পারে জিবিএস!

গিলিয়ান-বারে সিনড্রোম বা সংক্ষেপে জিবিএস এমন একটি স্নায়ুরোগ, যা আমাদের চারপাশে তেমন পরিচিত না হলেও এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক...

হংকংয়ে রানওয়ে থেকে ছিটকে সমুদ্রে পড়লো কার্গো বিমান, নিহত দুই নিরাপত্তাকর্মী।

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি কার্গো বিমান রানওয়ে থেকে ছিটকে সমুদ্রে পড়ে গেছে। এতে বিমানবন্দরের দুইজন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হয়েছেন।...