টাইফয়েডমুক্ত প্রজন্মের পথে বাংলাদেশ: বিনামূল্যে টিকা দিচ্ছে সরকার

Date:

Share post:

বাংলাদেশে টাইফয়েড একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। টাইফয়েড জ্বর Salmonella Typhi নামের ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ঘটে এবং দূষিত পানি বা অপরিষ্কার খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। দেশের অনেক এলাকায় এখনো বিশুদ্ধ পানি ও নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়ায় টাইফয়েড সংক্রমণের ঝুঁকি রয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ সরকার শিশুদের জন্য বিনামূল্যে টাইফয়েড টিকা দেওয়ার কর্মসূচি শুরু করেছে, যাতে দেশের প্রায় সব শিশুকে এই প্রাণঘাতী রোগের হাত থেকে রক্ষা করা যায়।

বাংলাদেশে বিনামূল্যের এই টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচি মূলত Typhoid Conjugate Vaccine (TCV) দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে, যা একবার ইনজেকশন আকারে দেওয়া হয় এবং দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা প্রদান করে। এই টিকা ছয় মাস বয়স থেকে দেওয়া যায়, তবে সরকারের সাম্প্রতিক জাতীয় টিকাদান অভিযানে ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু ও কিশোরদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই টিকাটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কর্তৃক অনুমোদিত এবং বর্তমানে সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকর টাইফয়েড টিকা হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ সরকার এই টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে Expanded Programme on Immunisation (EPI)-এর আওতায়, যেখানে UNICEF, Gavi (The Vaccine Alliance) এবং World Health Organization (WHO)-এর সহযোগিতা রয়েছে।

৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু এবং কৈশোররা এই ফ্রি টিকার আওতায় আছেন।

সরকারের লক্ষ্য হলো প্রায় ৫ কোটি শিশুকে বিনামূল্যে টাইফয়েড টিকার আওতায় আনা। এজন্য স্কুল, মাদ্রাসা, কমিউনিটি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও বিভিন্ন টিকাদান কেন্দ্রে বিনামূল্যে টিকা দেওয়া হচ্ছে। শহর ও গ্রাম— উভয় এলাকাতেই এই টিকাদান কর্মসূচি চলছে, যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরাও সুরক্ষিত থাকতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকদের জন্ম নিবন্ধন নম্বর ব্যবহার করে অনলাইনে নিবন্ধন করতে হয়, যাতে টিকা দেওয়া ও রেকর্ড সংরক্ষণের প্রক্রিয়া সহজ হয়।

Typhoid Conjugate Vaccine (TCV) শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে এবং একবার টিকা নিলেই ১০ বছর বা তারও বেশি সময় পর্যন্ত সুরক্ষা দেয়। ViCPS বা Ty21a ধরনের পুরোনো টিকার তুলনায় এটি অনেক বেশি কার্যকর এবং ছোট শিশুদের জন্য উপযুক্ত। টিকা নেওয়ার পর সাধারণত ইনজেকশনের স্থানে হালকা ব্যথা, ফোলাভাব বা অল্প জ্বর হতে পারে, কিন্তু এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক এবং দ্রুত সেরে যায়।

এই বিনামূল্যের টিকাদান কর্মসূচি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সাফল্য। এটি শুধু টাইফয়েড প্রতিরোধই নয়, বরং দেশের শিশুস্বাস্থ্য উন্নয়ন, মৃত্যুহার হ্রাস এবং রোগের অর্থনৈতিক বোঝা কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এই উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশগুলোর একটি, যারা জাতীয় পর্যায়ে টাইফয়েড কনজুগেট টিকাদান কর্মসূচি চালু করেছে।

সবশেষে বলা যায়, টাইফয়েড টিকা বিনামূল্যে দেওয়া বাংলাদেশের একটি অগ্রগামী জনস্বাস্থ্য উদ্যোগ, যা কোটি কোটি শিশুর জীবনে সুরক্ষার ঢাল তৈরি করছে। তবে টিকার পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, নিরাপদ পানি পান করা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি, যাতে টাইফয়েডসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগ থেকেও পরিবার ও সমাজকে সুরক্ষিত রাখা যায়। বাংলাদেশ সরকারের এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে একটি সুস্থ ও শক্তিশালী প্রজন্ম গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

Related articles

সালমান মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন,সামিরার কোনো দোষ দেখি নাই—ডনের মন্তব্যে

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়ক সালমান শাহের রহস্যজনক মৃত্যু আবারও নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। আত্মহত্যা নাকি হত্যা—এই বিতর্কে...

শরীর হঠাৎ অবশ হয়ে যাচ্ছে? সতর্ক থাকুন, এটি হতে পারে জিবিএস!

গিলিয়ান-বারে সিনড্রোম বা সংক্ষেপে জিবিএস এমন একটি স্নায়ুরোগ, যা আমাদের চারপাশে তেমন পরিচিত না হলেও এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক...

হংকংয়ে রানওয়ে থেকে ছিটকে সমুদ্রে পড়লো কার্গো বিমান, নিহত দুই নিরাপত্তাকর্মী।

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি কার্গো বিমান রানওয়ে থেকে ছিটকে সমুদ্রে পড়ে গেছে। এতে বিমানবন্দরের দুইজন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হয়েছেন।...

মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে তিন-তিনটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড গ্রাস করেছে দেশের তিন প্রান্তকে।

মিরপুর (ঢাকা) — রাসায়নিক গুদাম ও গার্মেন্টস কারখানায় আগুন ১৪ অক্টোবর, মঙ্গলবার, রাজধানী ঢাকার মিরপুর থানার শিয়ালবাড়ি এলাকায়...