শরীর হঠাৎ অবশ হয়ে যাচ্ছে? সতর্ক থাকুন, এটি হতে পারে জিবিএস!

Date:

Share post:

গিলিয়ান-বারে সিনড্রোম বা সংক্ষেপে জিবিএস এমন একটি স্নায়ুরোগ, যা আমাদের চারপাশে তেমন পরিচিত না হলেও এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। সামান্য লক্ষণ দিয়ে শুরু হওয়া এই রোগ ধীরে ধীরে শরীরকে সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে ফেলতে পারে। আমাদের হাত-পা নড়াচড়া, স্পর্শ ও তাপমাত্রা অনুভব করা থেকে শুরু করে শ্বাস-প্রশ্বাস পর্যন্ত সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে স্নায়ুতন্ত্র, যা মানবদেহের মাদারবোর্ডের মতো কাজ করে। গিলিয়ান-বারে সিনড্রোম এমনই এক জটিল অবস্থা, যেখানে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুলবশত পেরিফেরাল স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে। ফলে পেশি দুর্বল হয়ে যায়, হাত-পা নাড়ানো, কথা বলা, গিলতে এমনকি নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। গুরুতর অবস্থায় রোগী পুরোপুরি পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, যেকোনো বয়সেই জিবিএস হতে পারে, তবে ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী পুরুষদের মধ্যে এর ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। প্রাথমিকভাবে রোগের উপসর্গ বোঝা কঠিন। ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS)-এর তথ্য অনুযায়ী, জিবিএস সাধারণত পা থেকেই শুরু হয়। প্রথমে পায়ের আঙুল, পাতা ও গোড়ালিতে ঝিনঝিন, অসাড়তা বা সুই ফোটানোর মতো অনুভূতি হয়। এরপর ধীরে ধীরে সেই দুর্বলতা উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে—কোমর, হাত, মুখ পর্যন্ত পৌঁছায়। হাঁটতে, সিঁড়ি ভাঙতে বা বসা-ওঠায় কষ্ট হয়। মুখের পেশি ঝুলে পড়ে, খাবার গিলতে বা কথা বলতে সমস্যা হয়। এক-তৃতীয়াংশ রোগীর বুকের পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে শ্বাস নিতে সমস্যা হয় এবং অনেক সময় ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে সামনে থাকা একটি জিনিস দুটো দেখা যায়, যাকে ডাবল ভিশন বলা হয়।

তবে মনে রাখতে হবে, এসব উপসর্গ দেখা দিলেই যে কারও গিলিয়ান-বারে সিনড্রোম হয়েছে, এমন নয়। শরীরের অন্য জটিলতার কারণেও এমনটা হতে পারে। জিবিএস কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। এখন পর্যন্ত এই রোগের সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের পর এটি দেখা দেয়। যেমন—এইডস, হার্পিস, এপস্টাইন-বার ভাইরাস, জিকা ভাইরাস, মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া, এমনকি ডায়রিয়া বা ইনফ্লুয়েঞ্জার পরও জিবিএস দেখা দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ফ্লুর টিকা নেওয়ার পরও এর ঝুঁকি সামান্য বেড়ে যেতে পারে, যদিও চিকিৎসকেরা একে খুব বিরল ঘটনা বলেই মনে করেন।

রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে জিবিএস শনাক্ত করা কঠিন। চিকিৎসকরা সাধারণত রোগীর মেডিকেল ইতিহাস, শারীরিক দুর্বলতা ও স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া দেখে প্রাথমিক ধারণা নেন। এরপর নার্ভ কন্ডাকশন টেস্ট, ফুসফুসের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা (স্পাইরোমেট্রি), রক্ত পরীক্ষা ও লাম্বার পাংচার করা হয়, যেখানে মেরুদণ্ড থেকে তরলের নমুনা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়।

গিলিয়ান-বারে সিনড্রোম ধরা পড়লে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি। কারণ, রোগটি দ্রুত বাড়তে পারে এবং শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে স্নায়ুর ওপর আক্রমণ বন্ধ করা ও জটিলতা প্রতিরোধ করা। এ রোগের প্রধান চিকিৎসা হলো ইমিউনোথেরাপি, যেখানে রক্ত থেকে ক্ষতিকর অ্যান্টিবডি সরিয়ে ফেলা হয়। এর জন্য সাধারণত দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়—ইনট্রাভেনাস ইমিউনোগ্লোবুলিন (IVIg) থেরাপি বা প্লাজমা এক্সচেঞ্জ। পাশাপাশি রোগীর অবস্থান অনুযায়ী ব্যথানাশক, রক্ত জমাট প্রতিরোধক ওষুধ, কমপ্রেশন স্টকিংস এবং প্রয়োজনে ভেন্টিলেটর ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হয়। পেশি শক্ত হয়ে গেলে বা দুর্বলতা থাকলে ফিজিওথেরাপি অত্যন্ত কার্যকর। এটি মাংসপেশির ক্ষয় রোধ করে এবং শরীরের নড়াচড়া সহজ করে।

সময়মতো চিকিৎসা শুরু করলে অধিকাংশ রোগী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই উন্নতি অনুভব করেন। তবে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে কারও কারও ছয় মাস থেকে এক বছর, কখনও তিন বছর পর্যন্তও সময় লাগতে পারে। চিকিৎসা নিতে দেরি হলে স্থায়ী দুর্বলতা থেকে যেতে পারে এবং জটিল অবস্থায় শ্বাসকষ্ট, রক্ত সংক্রমণ বা হৃদরোগে মৃত্যুঝুঁকিও তৈরি হতে পারে। তাই সময়মতো সঠিক চিকিৎসা ও নিয়মিত ফলো-আপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন, রোগমুক্তির পরও প্রতি কয়েক মাস অন্তর বা অন্তত বছরে একবার পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। নিয়মিত ব্যায়াম, ফিজিওথেরাপি, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং মানসিক সহায়তা জিবিএস রোগীদের সুস্থতার পথে বড় ভূমিকা রাখে।


LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

spot_img

Related articles

সালমান মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন,সামিরার কোনো দোষ দেখি নাই—ডনের মন্তব্যে

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়ক সালমান শাহের রহস্যজনক মৃত্যু আবারও নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। আত্মহত্যা নাকি হত্যা—এই বিতর্কে...

টাইফয়েডমুক্ত প্রজন্মের পথে বাংলাদেশ: বিনামূল্যে টিকা দিচ্ছে সরকার

বাংলাদেশে টাইফয়েড একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বেশি। টাইফয়েড...

হংকংয়ে রানওয়ে থেকে ছিটকে সমুদ্রে পড়লো কার্গো বিমান, নিহত দুই নিরাপত্তাকর্মী।

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি কার্গো বিমান রানওয়ে থেকে ছিটকে সমুদ্রে পড়ে গেছে। এতে বিমানবন্দরের দুইজন নিরাপত্তাকর্মী নিহত হয়েছেন।...

মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে তিন-তিনটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড গ্রাস করেছে দেশের তিন প্রান্তকে।

মিরপুর (ঢাকা) — রাসায়নিক গুদাম ও গার্মেন্টস কারখানায় আগুন ১৪ অক্টোবর, মঙ্গলবার, রাজধানী ঢাকার মিরপুর থানার শিয়ালবাড়ি এলাকায়...