সম্প্রতি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় (বর্তমানের আবাসন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় নামেও পরিচিত) একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে— এখন থেকে সরকারি বা রাষ্ট্রীয় সংস্থার উন্নয়নকৃত ও বরাদ্দকৃত আবাসিক প্লট ও ফ্ল্যাট হস্তান্তর, নামজারি বা দলিল সম্পাদনে আর আলাদা অনুমতি নিতে হবে না। এই সিদ্ধান্ত দেশের রিয়েল এস্টেট, প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ও সাধারণ নাগরিকদের সম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি সংস্থাগুলোর উন্নয়নকৃত প্লট বা ফ্ল্যাট হস্তান্তরের ক্ষেত্রে মালিকদের একাধিক ধাপ পেরোতে হতো। যেমন— হস্তান্তরের আগে সংশ্লিষ্ট লিজদাতা সংস্থা (যেমন RAJUK, CDA, KDA, NHA ইত্যাদি) থেকে লিখিত অনুমোদন নিতে হতো, যা সাধারণত সময়সাপেক্ষ, জটিল ও প্রায়ই হয়রানিমূলক হয়ে উঠত। অনেক ক্ষেত্রে ছোটখাটো ভুলের কারণে আবেদন মাসের পর মাস ঝুলে থাকত। এই অনুমোদন প্রথা প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্নীতির সুযোগ বাড়াতো— এমন অভিযোগও বহু বছর ধরে আলোচিত ছিল।

২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে বা তত্ত্বাবধানে উন্নয়নকৃত আবাসিক এলাকা ও ফ্ল্যাট প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে “উত্তরাধিকারসূত্রে মালিকানা পরিবর্তন, বিক্রয়, দান, হেবা, বণ্টন, দলিল সম্পাদন, দলিল বাতিল, মোখতারনামা সম্পাদন বা বাতিল, এবং ঋণগ্রহণের জন্য অনুমতি”— এসবের জন্য আর আলাদা অনুমোদন নিতে হবে না। অর্থাৎ এখন থেকে সংশ্লিষ্ট ক্রেতা-বিক্রেতা সরাসরি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল নিবন্ধন করতে পারবেন, এবং নির্ধারিত রেজিস্ট্রেশন ফি পরিশোধ করলেই হস্তান্তর বৈধ বলে গণ্য হবে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আবাসিক ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে দলিল মূল্যের ২ শতাংশ এবং প্লট বা ভূমির ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ হারে নিবন্ধন ফি দিতে হবে। দলিল নিবন্ধন সম্পন্ন হওয়ার পর হস্তান্তরের সকল কাগজপত্র ৯০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট লিজদাতা প্রতিষ্ঠানে জমা দিতে হবে। এরপর ওই সংস্থা ৩০ দিনের মধ্যে মালিকানা হালনাগাদ করে নতুন মালিককে ডাকযোগে বা ই-মেইলে অবহিত করবে। যদি এই সময়সীমা মানা না হয়, তাহলে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
তবে এই সুবিধা সীমাহীন নয়। প্রজ্ঞাপনে কিছু ব্যতিক্রমও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন—
- যদি কোনো প্লট বিভাজন বা একাধিক প্লট একত্র করার প্রয়োজন হয়,
- অথবা প্রকল্পের মাস্টারপ্ল্যান, লে-আউট বা ব্যবহার শ্রেণি পরিবর্তনের প্রশ্ন আসে,
- কিংবা যদি প্লট বা ফ্ল্যাটের মালিকানা নিয়ে বিরোধ থাকে,
তাহলে এই নতুন নিয়ম প্রযোজ্য হবে না, অর্থাৎ তখনও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হবে।
এছাড়া ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত “বিশেষ বিবেচনায় বরাদ্দকৃত” প্লট ও ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রেও পুরনো অনুমোদন প্রথা বহাল থাকবে। কারণ এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক, মানবিক বা প্রশাসনিক বিবেচনায় অনেক ব্যতিক্রমী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, যার কিছু এখনও যাচাই-বাছাইাধীন।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এই প্রজ্ঞাপন “কেবলমাত্র আবাসিক উদ্দেশ্যে” বরাদ্দকৃত সম্পত্তির জন্য প্রযোজ্য। বাণিজ্যিক, শিল্প, মিশ্র বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত জমি বা ফ্ল্যাটে এটি কার্যকর হবে না। তাছাড়া যেসব সম্পত্তি পরিত্যক্ত তালিকাভুক্ত বা গেজেটভুক্ত হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও অনুমোদন ছাড়া হস্তান্তর করা যাবে না।
এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই প্রশাসনিক সেবা সহজীকরণের মাইলফলক হিসেবে দেখছেন। দেশের বড় বড় শহরে যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও গাজীপুরে সরকারি সংস্থার উন্নয়নকৃত প্লট বা ফ্ল্যাট প্রকল্পে হাজার হাজার বরাদ্দগ্রহীতা আছেন— যাদের অনেকে বছরের পর বছর ধরে অনুমোদনের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। এই প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ায় এখন তাদের সময়, অর্থ ও মানসিক চাপ অনেকটাই কমবে।
অন্যদিকে, অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি রিয়েল এস্টেট বাজারে লিকুইডিটি (তরলতা) বাড়াবে। পূর্বে অনুমোদন জটিলতার কারণে সরকারি প্রকল্পের ফ্ল্যাট বা প্লট সহজে কেনাবেচা সম্ভব হতো না; এখন তা সহজ হবে। এতে বাজারে সম্পত্তির গতি বাড়বে, বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে, এবং রেজিস্ট্রেশন ফি-এর মাধ্যমে সরকারও রাজস্ব পাবে।
তবে কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, পুরো অনুমোদন ব্যবস্থা বাতিলের ফলে যদি যথাযথ রেকর্ড-নির্ভর মনিটরিং না থাকে, তাহলে ভুয়া দলিল, প্রতারণা বা দ্বৈত বিক্রয়ের ঝুঁকিও বাড়তে পারে। এজন্য প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, প্রতিটি হস্তান্তরের কাগজপত্র নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লিজদাতা সংস্থায় জমা দিতে হবে— যাতে সংস্থাগুলো তাদের ডাটাবেসে মালিকানা হালনাগাদ রাখতে পারে।
মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই সিদ্ধান্ত “গুড গভর্ন্যান্স ও ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস” উদ্যোগের অংশ। তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে সরকারি সম্পত্তি হস্তান্তরে অনুমোদন প্রক্রিয়া মানুষকে হয়রানি করেছে। এখন থেকে অনুমোদন লাগবে না, তবে তথ্যসংরক্ষণ নিশ্চিত থাকবে। এতে প্রশাসনিক কার্যকারিতা বাড়বে এবং জনগণের আস্থা ফিরবে।”
আইনগতভাবে, এই প্রজ্ঞাপন “গণপূর্ত ও গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক নির্দেশাবলী-২০২৫”-এর আওতায় জারি করা হয়েছে। এটি তৎক্ষণাৎ কার্যকর হবে বলে উল্লেখ রয়েছে, অর্থাৎ প্রকাশের দিন থেকেই নতুন নিয়ম প্রযোজ্য।
এই সংস্কার বাংলাদেশের ভূমি ও আবাসন ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। দীর্ঘদিনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে এনে সাধারণ নাগরিকদের জন্য একটি দ্রুত, স্বচ্ছ ও নাগরিকবান্ধব সেবা কাঠামো গড়ে তোলাই এই সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য। তবে এর সফলতা নির্ভর করবে প্রয়োগের সঠিকতা, তথ্যভিত্তিক রেকর্ড সংরক্ষণ, ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর আন্তরিকতার ওপর।


